| ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১১:১৪ অপরাহ্ণ
এ এক আজব সময়ের মধ্য দিয়ে দিন পার করছি আমরা। কোনো কিছু ঘটলেই হুলুস্থুল লেগে যায়। পক্ষে বিপক্ষে শুরু হয়ে অনলাইন যুদ্ধ। কে কাকে ভুল প্রমাণ করবে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। উল্লেখিত বিষয়ে জ্ঞান যথেষ্ঠ থাকুক আর না থাকুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া শুরু হয় একের পর এক শব্দ বোমা। এ যেনো উৎ পেতেই বসে থাকা। বিপক্ষে বলাই যেনো একমাত্র কাজ। পাঠকদের খুব বেশি রাগ করার কারণ নেই, কথাগুলো আমাকে সহই বলা। অধিকাংশ পরিচিত মহলকেই এহেনাবস্থায় নিমজ্জিত দেখছি। হ্যা, মতামত দেয়া বা কথা বলা যেতেই পারে। যথাযথ প্রমাণ, যুক্তি ও গঠনমূলক কথা মালার সাজানো বাহার যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। পক্ষে হোক বিপক্ষে হোক থাকতে হবে যথাযথ কথাপ্রযুক্তি। যাহোক, কে মানে কার যুক্তি! অতিসম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’দিন ছুটির ঘোষণা করেছে সরকার। আর এতেই শুরু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা মিলছে হাজারো কথার সমাহার। শত সুবিধা পেয়েও শিক্ষা জীবনে যারা মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেনি তাদেরকেও রসালো কথায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তাদের কাছে শিক্ষকদের ছুটির এক আজব তালিকা রয়েছে। যা একেবারেই ভিত্তিহীন। ইন ফ্যাক্ট, বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যেখানে সরকারি প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকে সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকে। শুধু খোলা রাখলেই চলে না, দিবসটি পরিপূর্ণরুপে বাস্তবায়ন করতে হয়। রমজান ও ঈদুল ফিতরের যে ৩৫ দিন ছুটি দেখানো হয় এবছর সেখানে ২০ রমজান পর্যন্ত শিক্ষকদের শ্রেণী পাঠদান করতে হয়েছে। এমনটা প্রায় প্রতি বছরই হয়। নেটিজেনদের কাছে বন্ধের যে তালিকা সেখানে পাবলিক পরীক্ষার ৩৬ দিন বন্ধ ধরা হয়েছে। কি হাস্যকর! তাদের মনে একবারো প্রশ্ন জাগেনি, পরীক্ষাগুলো কে গ্রহণ করে? কি সব উদ্ভট বন্ধের হিসেব তাদের কাছে। পরীক্ষা শিক্ষা কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজেই জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে যে বন্ধের কথা বলা হযেছে তা সত্যিই ভিত্তিহীন। বরং এ সময়টাতে শিকক্ষকদের আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকতে হয়। যে কারণে শিক্ষামন্ত্রী কয়েকবারই বলেছেন অন্যান্য পেশাজীবিদের চেয়ে শিক্ষকদের ছুটি কম। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালেই দেখা যায় ভালো মানের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহে দু’দিন শ্রেণী কার্যক্রম বন্ধ। বহি:বিশ্বের দিকে তাকানোর দরকার নেই। আমাদের দেশের ভালো ফলাফলের সকল প্রতিষ্ঠানই শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ থাকছে। বিগত ১০-১২ বছর আগে থেকে সপ্তাহে দু’দিন বন্ধ থাকা এ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই আমাদের সন্তানদের ভর্তি করানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পরি। তাছাড়া এখন শ্রেণি পাঠদানের সংখ্যাও একটি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে আগে যেখানে বৃহস্পতিবার অর্ধেক বেলা শ্রেণী পাঠদান চলতো সেখানে এখন পূর্ণ দিবস চলছে। তাহলে বলা যায় শনিবারে যে ছুটি ঘোষণা হয়েছে তা মূলত শিক্ষকদের জন্য অর্ধেক বেলা বর্ধিত হয়েছে, পূর্ণ দিন নয়।
কাজেই আলোচনা কিংবা পর্যালোচনা যেটাই হোক সমস্যাগুলো যেনো বের হয়ে আসে। না বুঝে হইচই কাম্য নয়। সাহস হলে আসুন এ খাতের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলি। টিআইবির তদন্ত রিপোর্ট বলছে দুর্নীতিতে ৮ম স্থানে শিক্ষাখাত। শিক্ষা কর্মকর্তাসহ অসংখ্য শিক্ষক রয়েছেন যারা আপদমস্তক দুর্নীতিতে ঘেরা। পরপর কয়েকদিন মিডিয়াতে যা দেখছি তাতে রাগে-দুঃখে বুকে খিল লেগে আসছে। ‘দুই সন্তানের বাবা সেজে শিক্ষা ভাতা নেন নিঃসন্তান প্রধান শিক্ষক’! এমন শিরোনামে গত ৭ তারিখ দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করেছে। গাজীপুরের সদর উপজেলার সিংরাতুলি শহিদ আহসান উল্লাহ মাস্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিঃসন্তান থাকলেও দুই সন্তানের নাম ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ভাতা গ্রহণ করছেন। প্রভাবশালী ওই প্রধান শিক্ষক স্কুলের সভাপতি ও শিক্ষা অফিসকে ম্যানেজ করেই এমন কাজ করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কি ভয়ানক! ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নাকি অসামাজিক কার্যকলাপেরও অভিযোগ রয়েছে। গত ৩ তারিখে দেশের প্রায় শীর্ষস্থানীয় সকল মিডিয়াতে প্রকাশ হওয়ার সুবাদে দেখলাম কুড়িগ্রামে এক শিক্ষক অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান বানিয়ে মাতৃত্বকালিন ছুটি ভোগ করছেন। হাসবো না কাঁদবো নাকি ওই গুণধর শিক্ষককে সালাম করে আসবো বুঝে উঠতে পারিনি। আচ্ছা আরো একজন শিক্ষকের কথা না বললে ওপরের দু’জনের সাথে অবিচার করা হবে। আমাদের গাজীপুরের ঘটনা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষক স্কুলের ভেতরেই কিন্ডার গার্টেন খোলে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন। শুধু কি তাই ওই সরকারি স্কুলের শ্রেণিকক্ষ ব্যবহার করেই এমন কার্যক্রম তিনি দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে আসছেন। সরেজমিনে খোঁজ করলে হয়তো এমন আরো অসংখ্য শিক্ষকের ভয়াবহ অপরাধমূলক কার্যকলাপ বেরিয়ে আসবে। থাকলে বেরিয়ে আসুক সেটিই কামনা করি। সাংবাদিক বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাই এমন অপরাধীদের ঘটনা প্রকাশের জন্য।
এবার আমরা যারা শিক্ষকতা নামক মহান এ পেশাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নতুন হিসেবে সম্পৃক্ত হয়েছি তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার একটা ছবি কল্পনায় আঁকা যাক। তা না হলে পাঠক বন্ধুদের অনেকেই হয়তো একটা ভুলের মধ্যে থেকে যাবেন। আমার বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরে। কয়েকদিন আগে টানা তিন দিন আমাদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো। ভাতিজা ও ভাতিজি’র বিয়ের অনুষ্ঠান। বিশেষ অসুবিধা থাকার কারণে ছুটির দিনে বিয়ের তারিখ করা যায়নি। আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহোদয় সহ প্রায় সকল ওয়ার্ডের মেম্বার সাহেবরা সারাদিন সময় ব্যায় করে উপস্থিত থেকে এ মহতি কার্যক্রম সু-সম্পন্ন করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আমি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর যমুনা নদীর কুল ঘেষে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত থাকার কারণে ছুটি নিতে পারিনি। শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনে শ্রেণি পাঠদান শেষ করে ১ শ কিলোমিটার বাইক ড্রাইভ করে গিয়ে ভাতিজিকে স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। পরের দিন ভোরে আবার চলে এসেছি। শ্রেণি পাঠদানে অংশ নিয়েছি। চেয়ারম্যান মহোদয় সহ সম্মানিত সকল মেহমানরাই আমার ঘরে বসেই আমাকে বকাঝকা করেছেন। কেনো ছুটি নিলাম না? প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে সন্তানতূল্যই মনে করেন, ছুটি চাইলে দিতেন। কিন্তু যেখানে শুক্রবার ও শনিবার শিক্ষকদের জন্য ছুটি সেখানে আবার বাকী ৫ দিনের মধ্যেও যদি ছুটি কাটাই তবে নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাই। (যদিও শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে নৈর্বৃত্তিক ছুটি নিতেই পারেন)। যাহোক নিজের কথা বলে ফেললাম। ক্ষেত্রে বিশেষে উদাহরণ টানতে গিয়ে অনেক সময় নিজের প্যাচাল কিছুটা করতে হয় বৈকি। অন্যথায় আলোচনার সারমর্ম বের করে আনা যায় না। এমন হাজারো শিক্ষক রয়েছেন যারা মহান এ পেশাকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করেন। জীবিকা নির্বাহের অন্যান্য সুযোগ থাকার পরও মহান এ পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। জাতি গড়ার মহান দায়িত্বে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছেন। কাজেই শিক্ষকদের কাজ মাথা খাটানো। মাথা খাটিয়ে বের করতে হয় শিক্ষার্থীদের সমস্যা কী, কী সমাধান দেয়া যায়। শুধুমাত্র একাডেমিক সমাধানই কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষক দেন না। বরং শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের সকল সমাস্যারই সমাধানের পথ খোঁজে বের করে দেন একজন শিক্ষক। শিক্ষকদের একই সাথে মাথা এবং হৃদয় উজার করেই কাজ করতে হয়। তবেই গিয়ে একজন ছাত্র হয়ে উঠে সফল উদ্যোক্তা, আগামির রাষ্ট্র নায়ক কিংবা দেশের সংবিধান প্রণেতা। কাজেই শিক্ষকদের বিশ্রামের প্রয়োজন অন্যান্য পেশাজীবিদের থেকে একটু বেশিই।
লেখা শেষ করবো। তবে তার আগে আরো গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা বলে যাই। একজন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বলছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’দিন ছুটি রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা যুযোপযোগি এবং যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত। যদি এ আদেশ একটি নির্দিষ্ট বড় সময় ধরে বহাল থাকে। নতুন কারিকুলামের অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়, বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে বিগত ভালোর সকল রেকর্ড ভাঙবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা শুদ্ধতার শক্তিশালি বিদ্যা অর্জন করবে। তবে ওই যে ওপরে বললাম শিক্ষক ও শিক্ষাখাতে সম্পৃক্ত কর্মচারিদের অপরাধ কার্যক্রম ওসবের ইতি ঘটাতে হবে। অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততা প্রমাণ হলে শুধু বরখাস্ত নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আইন পাশ করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের জন্য আলাদা আইন হোক। শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি বাড়াতে হবে। বেতন কাঠামো এমন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে যাতে একজন শিক্ষককে পরিবার চালাতে আর্থিক সমস্যায় পড়তে না হয়। অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করতে না হয়। এনটিআরসিএ কর্তৃক যে সমস্ত শিক্ষকদের শতশত মাইল দূরে পোস্টিং হয়েছে তাদের নিজের উপজেলায় বদলি করতে হবে। দ্রুত বদলি কার্যক্রম শুরু করতে হবে। অন্যথায় একজন শিক্ষক তাঁর স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মা রেখে কোনোভাবেই প্রপার জ্ঞান বিতরণ করতে পারবে না। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রটা আরো বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে একজন শিক্ষকের শ্রেণী পাঠদান এবং প্রশিক্ষণের মাত্রা অর্ধাঅর্ধি পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। নতুন কারিকুলামের ওপর শিক্ষকদের সুদক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণ শিখনফল বাস্তবায়ন কমিটি থাকতে হবে। এ বিষয়ে একাডেমিক সুপারভাইজারসহ সংশ্লিষ্ট ওপর মহলের সার্বক্ষণিক তদন্ত বাড়াতে হবে।
বহু বছর থেকেই তো এই একই শিক্ষা ব্যবস্থা এবং কারিকুলাম দেখে আসছি। শিক্ষাখাতে কি খুব বেশি আমরা এগুতে পেরেছি? স্বাধীনতার পর এই যে লম্বা সময় যেখানে আমাদের পৌছার কথা সেখানে কি আদৌ পৌছতে পেরেছি। মোটেও পারিনি। তাই বলছি চলুন পজিটিভলি দেখি নতুন কারিকুলাম কতটা সুফল বয়ে আনে। আসুন সমস্যাগুলো খুঁজে বের করি এবং সেগুলোর সমাধানে সমন্বিতভাবে কাজ করি। প্রয়োজনে সমস্যাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। ঠিক যেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং মাতামাতি করা দরকার সেগুলো যেনো রহস্যের অন্তরালে থেকে না যায়। সে দিকেই সকলের কড়া নজর দিতে হবে।
লেখকঃ সোলায়মান মোহাম্মদ
শিক্ষক ও কলাম লেখক
সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র | শনি | রবি |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ||
৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ |
১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ |
২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ |
২৭ | ২৮ |